এ নদী সবই জানে
-রাখী সরদার
জলের পাড়ের ওপর ঝোপে কেন পতঙ্গরোদ্দুর চুপ করে বসে থাকে,প্রাচীন লতা টুকরো করতে করতে রামি চণ্ডীদাসের চোখে কী দেখেছিল ,কোন পথে ঘুরে ঘুরে গাছে বাসা বেঁধেছিল গর্ভবতী মেঘ এ নদী সবই জানে ।যার যখনই দেয়াল ভেঙেছে, একলা বাতাসে উড়ে গেছে সম্পর্কের টান সে তখনই এ নদীর জলে চিবুক ডুবিয়ে নিজেকে মেপেছে।ঝাপসা চোখে বলে গেছে এক একটা মিহিন চাঁদ রাতের কথা ।
এই যেমন হলুদ ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটি দুহাতে ঢেউ সরিয়ে সরিয়ে খুঁড়েছিল বালি।সে শুনেছিল তার মায়ের ভাঙাচোরা ছায়া নাকি সেখানে কোথাও পোঁতা আছে।প্রতি এপ্রিলে বাবার কাছে আব্দার
করে –‘ঢেউ দেখবো,ঢেউ দেখবো।’প্রতিবার বাবা নিয়ে যায়।হলুদ রোদ্দুর যতক্ষণ সমুদ্রের গায়ে
হেলান দিয়ে থাকে মেয়েটি মুঠো মুঠো বালি খোঁড়ে।
প্রথমে নখ,তারপর আঙুল,তারপর কব্জি চিৎকার করে –‘আর নয়, রেহাই দাও,ফিরে চলো’ক্ষুধার্ত মন
নিয়ে ফিরে যায়,ফিরে যায় মুঠো মুঠো নুন ফেনা আর স্বপ্নে দেখা মায়ের ভাঙা শাঁখার টুকরো নিয়ে।
তারপর কবে কবে হলুদ ফ্রক লাল হয়,নীল হয়,ক্রমে ফ্যাকাসে।একদিন লুকানো সন্ধেয় মেয়েটি
চলে আসে এ নদীর কাছে।উদ্ভট উপাখ্যান জলে ভাসিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া নখ নিয়ে ফিরে যায় খুঁটিনাটি
জীবনে ।
এইতো তেরই বৈশাখে খাঁ খাঁ দুপুর মাথায় করে পোড়ো ভিটের ঘুঘুটি উড়ে এলো নদীর তীরে।সূর্য তখন গলে গলে পড়ছে।উড়তে উড়তে ঘুঘুর ঠোঁটে কালচে ধোঁয়া পাক খাচ্ছে, ডানা গেছে ছড়ে ।চোখের রক্তাভ লাল পোড়া শালপাতার মতো জ্বলছে।নদীর বুক ঠুকরে দু ফোঁটা জল নিতে গেল বেচারা ঘুঘু,পারলনা স্খলিত বীর্যের মতো টুপ করে নদীর জিনিস নদীতে ফিরে গেল।শেষে নদী মোচড় মেরে ঢেউ তুলে ঘুঘুর ঠোঁটে দিল সফেদ মিস্টি ফেনা। প্রাণ পেল ঘুঘু।নদীর কাঁধে হাত রেখে বলে গেল নকশা জীবনের কথা —-
একদিন অন্ধকারের সাথে ঝগড়া করে লাল বাড়িতে বাঁধি বাসা।চোরা প্রেমের টানে পেটে ডিম আসে।লাল বাড়ির খোকা খুকির মতো লালচে ডিম।হাল্কা রোঁয়া ওঠা দুটো বাচ্চা।সারাদিন শসাখেতে সবুজ ফড়িংয়ের পিছুপিছু।দেখতে দেখতে ওরা বড় হয়,ডানা নাড়ে,একে একে উড়ে
যায় গাছগাছালির বাঁকে। পুরোটাই স্বপ্ন ,লাল বাড়ির খোকা খুকি ভাঙা গল্পের মতো ভেঙে ফেলে ডিম দুটি।বড় মায়া।ছেড়ে যেতে পারিনা ওদের।দিন যায়।প্রতিদিন ফরি যাই সেই অন্ধকার গুহায়।থাকতে পারিনা, সূর্যের পিছন পিছন চলে আসি লালবাড়ির ছোট্ট সেই বাসায়।রাতে সবথেকে বড় তারাটির সাথে খুনসুটি সেরে ঘুমিয়ে পড়ি।একদিন ভোরে স্পষ্ট দেখি খোকা খুকি ভিজে পাতা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে।ডানা ঝাপটাই যেওনা।শোনেনি ওরা।কত বিকেল দেখেছি কার্ণিশে ঝুলে ঝুলে ক্লান্ত হয়েছে।দেয়াল থেকে বালি,সিমেন্টর চাঙড় আলগা হয়ে পা টিপে টিপে নেমে গেছে ঝোপে ঝাড়ে।তবুও জীর্ণ বাসায় বসে থেকেছি।খোকা খুকি ফিরে আসবে ।ওরা আমার সেই লালচে ডিয যে।আজ নিচের চাতালে হঠাৎ সবশুদ্ধ নেমেআসি।পোড়ো ভিটে সাফ চলছে।ডানায় যেটুকু সুর ছিল তাও শেষ…
কিছু কিছু কথা গোপনে পা ফেলে নদীর কাছে হেঁটে আসে।সারাদিন শুকনো ঝাঁটিঘাসের ঝোপের আড়ালে চুপ হয়ে থাকে।রাতে বিশাল আকাশে বুক চিতিয়ে চাঁদ উঠলে জল ঘেঁষে দীর্ঘ শ্বাস পড়ে। ঘুমহীন শহর থেকে তখন কোন মৃতপ্রায় সৈনিক এসে বসে নদীর কোলে।সৈনিকের ঘাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে যায় রক্তের স্রোত।বলিষ্ঠ উরু বুলেটের অবিশ্বাস্য হাসিতে ফেটে পড়ছে।কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সৈনিকের।অতীত ও বর্তমানের মাঝের ব্রিজটা নড়তে থাকে।সৈনিক ব্রিজের মাঝ বরাবর গিয়ে না এগোতে পারে না পিছিয়ে আসতে পারে।কোন এক সুকোমল বিকেলে দেখা হয়েছিল প্রিয় বন্ধুর সাথে। হাসি,গল্প,সিগারেটের ধোঁয়ায় মনের অন্ধকার পর্দা উড়িয়ে দিয়েছিল।প্রেমিকার হিমজল ছোঁয়া কালো তিলের ছোঁয়া ছুঁয়ি খেলার কথাও বলেছিল।তারপর প্রবল ঢেউ এর মতো ডাক আসে।ফিরে যেতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে।চিন্ময় বসন্ত ফেলে চলে যেতে হয়।একটা একটা শত্রু পক্ষের গুলি ছুটে আসতো আর নির্ভীক সৈনিক শেষ চুম্বনের কথা মনে রেখে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ফিরিয়ে দিত শত্রু পক্ষের বুকের ক্ষেতে।একদিন সাদাকালো বৃষ্টির ভিতর একটা চিঠি এসে পড়ে ——“পুরনো ক্যালেন্ডার ছিঁড়ে ফেলেছি।”সৈনিক এর ভিতরটা ভেঙে যাওয়া বাবুইয়ের বাসার মতো হয়ে পড়ে।টুকরো টুকরো ঘাস পাতা উড়ে যায়। ভৌতিক দাবানল আছড়ে পড়ে শরীরে যখন শোনে বন্ধুর উষ্ণতায় তার প্রেমিকা আহত।মুহূর্তে সমস্ত হাড়ের খিলান নড়ে ওঠে। ভাঙাচোরা একজোড়া মুখ চোখের সামনে অশ্লীল ভঙ্গিতে নাচতে থাকে।আঁকাবাঁকা অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দুকের তীক্ষ্ম আলো।সৈনিক বিবর্ণ ল্যাম্পপোস্টের মতো পড়ে যায় ।তারপর অনেক গুলো নিরক্ষীয় গ্রীষ্ম পার হয়ে যায় । আবার যুদ্ধ শুরু।বারবার মৃত্যুর জাল বুনতে থাকে,পারেনা। পৃথিবী যেন বিষাদের পালকে পোড়ার জন্য সৈনিক কে দানপত্র হিসেবে এই অগম্য পথে ফেলে রেখেছে।বিয়োগফলের মতো কাটাকুটি খেলতে
খেলতে এসে পড়েছে এ নদীর কাছে।চোখের কুয়াশা ঘন হয়ে ওঠার আগে ব্রিজ পেরোতে চেয়েছে।নদীর জলে স্মৃতির সজ্জা ধুয়ে ফেলতে চেয়েছে নিঃসঙ্গ সৈনিক।
এক বর্ষার সন্ধ্যায় নদী একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করছিল,সারাটাদিন মেঘ বৃষ্টির পাগলামিতে অস্থির হয়ে পড়েছিল।কখনো জলকে হিজিবিজি আলপনা আঁকতে হচ্ছিল তো কখনো দুঃসাহসী মেয়ের মতো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পাতালপুরির অসুররাজের দিকে ঢেউ ছুটিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। সারাদিন পর বাঁকা চাঁদের ফালির সাথে একটু প্রেমালাপে ব্যাস্ত এমন সময় চাপা কান্নার আওয়াজ আসে।কুমুদ চাঁদ বলে ওঠে —‘ওগো নদী, দেখো দেখো ওই যে দূরে কে ভেসে আসে ।’ একটা আধপোড়া চিতাকাঠ ভেসে আসছে।সমস্ত শরীর পুড়ে ছাল উঠে আছে।বুকের কাছে খাঁ খাঁ শূন্য। বড় করুণ অবস্থা।দাহচুল্লী থেকে কোনরকমে ঝাঁপিয়ে নদীতে পড়েছে।পালিয়ে আসা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা যে।প্রতিদিন পোড়া মাংসের গন্ধ আর কত সহ্য করা যায়।কচি বাচ্চার নাভি,অবুঝ ছেলেটির মায়ের কোমল হাত,অষ্টাদশীর পদ্মস্তন
এ সব সব কিছু চিতাকাঠের বুকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হত।কষ্ট হচ্ছে বললেও কেউ শুনতো
না,সেই যবে থেকে শশ্মান সংসারে ঘর পেতেছে তবে থেকেই শুরু হয়েছে এ যন্ত্রণা।কালো অভিশাপ সবসময় ছায়ার মতো পিছু পিছু ঘোরে।কত মা যে তাকে রাক্ষুসী বলে গালাগালি দিত প্রতিদিন তার
ঠিক নেই।আর পারলাম না।ভেসে পড়লাম।তারপর ক্ষয় হতে হতে একদিন ঘুমিয়ে পড়বো নদীর ভিতরপানে সেই কাদা বালির দেশে…আরও আরও কতজনের গভীর আর্তনাদ নিঃশব্দে বয়ে নিয়ে চলেছে নদী নিজেই জানেনা।জানবেই বা কিভাবে।এ নদী প্রতিদিন নিজের জলকণার পৃষ্ঠায় লিখে চলেছে শত কান্নার আঁকিবুকি।যার যখনই কষ্ট হয়েছে এসে বসেছে নদীর পাশে।স্তব্ধ একতারায় সুর তুলে নিদারুণ মুহুর্তকে ভুলতে চেয়েছে…অনেক যাতনা পেরিয়ে চলে আসি। ছিঁড়ে ফেলি তুমুল দুঃখ যে কোমল আগুনে যতটুকু পুড়েছি বাকিটা বাঁচানোর ইচ্ছেয় জলে নামি, মাঝরাতে আকাশ ফুরিয়ে গেলেও পাশে থাকে উৎসুক ঘন জল । স্পষ্ট বুঝতে পারি আর কেউজানুক বা না জানুক এ নদী সবই জানে…